ঢাকা, রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

অর্থনীতিতে মেট্রোরেলের ইতিবাচক প্রভাব

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:০৬, ১৮ নভেম্বর ২০২৩  

অর্থনীতিতে মেট্রোরেলের ইতিবাচক প্রভাব

অর্থনীতিতে মেট্রোরেলের ইতিবাচক প্রভাব

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন ওই রুটের যাত্রীরা। বিরোধী দলের অবরোধের মধ্যেও ভয়ভীতি কাটিয়ে মেট্রোরেলে চড়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্ট উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। যানজটের নগরী রাজধানী ঢাকায় যানজটের তীব্রতায় সামান্য দূরত্ব পাড়ি দিতেও লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই মহানগরীতেই ২০ কিলোমিটার পথ আধা ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ে পাড়ি দিতে পারার অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতো বলেই ব্যাখ্যা করেছেন মেট্রোতে চড়া যাত্রীরা। অনেককেই দেখা গেছে সেলফি তুলে অভিজ্ঞতা ফ্রেমবন্দি করে রাখতে।

চাকরির সুবাদে কাজীপাড়া স্টেশন থেকে মেট্রোতে চেপে মতিঝিল এসে আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত এক যাত্রীর ভাষ্য, এত অল্প সময়ে মতিঝিলে চলে আসব কখনো ভাবিনি। যানজটের এ শহরে মেট্রোরেলের এ যাত্রা আসলেই স্বপ্নের মতো। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল ছিল পূর্বনির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এই চার ঘণ্টায় যাত্রীরা উঠতে-নামতে পেরেছেন মতিঝিল, সচিবালয় ও ফার্মগেট স্টেশনে। তবে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনে মেট্রো চলাচল ছিল আগের মতোই রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। আগামী তিন মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে সময় বাড়িয়ে দুই অংশের মেট্রো চলাচলের সময় সমান করা হবে। খুলে দেওয়া হবে বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন।

মেট্রোরেলের এ অংশটি সম্প্রসারিত হবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এর ফলে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে মেট্রোরেল ব্যবহার করা সম্ভব হবে। একই সুযোগ পাবেন বিমানবন্দরের যাত্রীরা। মেট্রোরেলের ফলে রাজধানীর যানজট কিছুটা হলেও কমবে। হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। পাতালরেল তৈরির কাজও চলছে। এর ফলে রাজধানীর যাতায়াত ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। আসবে স্বাচ্ছন্দ্য। এশিয়ার মধ্যে ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে শহরের ভেতরে গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেলের মতো সেবা চালু রয়েছে। এলাকাভেদে এগুলো মেট্রোরেল, সাবওয়ে, ইউ-বানসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিশ্বে প্রথম মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয় লন্ডনে, ১৮৬৩ সালে। আর এশিয়ায় প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় জাপানের টোকিও শহরে ১৯২৭ সালে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মেট্রোরেল সেবা রয়েছে চীনে। চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের একাধিক শহরে মেট্রোরেল সেবা রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে মেট্রোরেলে ট্রেন চলাচল করবে ২৪টি। এ ট্রেনগুলোতে ছয়টি করে কোচ থাকবে। তবে এ কোচের সংখ্যা পরবর্তী সময়ে যেন আটটি করা যায়, সেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে এটির। প্রতিটি ট্রেনে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩০৮ জন করে।

সেই হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় মেট্রোরেল ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিদিন মেট্রোরেলে যাওয়া-আসা করতে পারবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ সালে দৈনিক যাত্রী চলাচলের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫ লাখ ৮৩ হাজারে এবং তা ২০৫১ সালে বেড়ে দাঁড়াবে দৈনিক ১৩ লাখে। সড়ক মহাসড়ক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যোগাযোগের নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু তারপরও এ বছরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক জরিপে উঠে আসে যে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। ১৫২টি দেশের ২০০টিরও বেশি শহরের যান চলাচলের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয় ওই জরিপটি। মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হলে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকার মানুষ তীব্র যানজট থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, গত ১০ মাসে মেট্রোরেলে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেছেন, তাদের প্রায় ৬০ ভাগই এতদিন বাসে যাতায়াত করতেন। এ কারণে মেট্রোরেল চালু হলে রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমবে এবং তা যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের মাথার মুকুটে অহংকারের আরেকটি নতুন পালক যুক্ত হলো। বাঙালি এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে। সব বাধা অতিক্রম করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গড়ে তুলবেন স্মার্ট বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করেছেন। মেট্রোরেলের ফলে একই সঙ্গে প্রযুক্তিতে চারটি মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত, মেট্রোরেল নিজেই একটি মাইলফলক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ প্রথম বৈদ্যুতিক যানের যুগে প্রবেশ করল। তৃতীয়ত, মেট্রোরেল রিমোট কন্ট্রোল যান। ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ধাপ। চতুর্থত, বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন যানের যুগে প্রবেশ করল। মেট্রোরেলে সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। মেট্রোরেল বাংলাদেশের মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশও যে পারে সেটি প্রমাণিত হয়েছে। মেট্রোরেল পরিপূর্ণভাবে চালু হলে যানজটের নগরী হিসেবে ঢাকার পরিচিতি বদলে ফেলা সম্ভব হবে। প্রকৃত অর্থেই এখন বাংলাদেশে উন্নয়নের গতি সঞ্চারিত হয়েছে। স্বপ্ন থেকে পদ্মা সেতু এখন বাস্তব হয়েছে। যানজটের নগরীতে যাত্রীদের নতুন অভিজ্ঞতা আর স্বস্তির যাত্রার স্বপ্ন দেখিয়ে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চললে মেট্রোরেলের মাধ্যমে গণপরিবহনের নতুন রূপের সঙ্গে পরিচিত হবে নগরবাসী। তাদের মতে, ঢাকার বর্তমান অবস্থায় মেট্রোরেল লাইফলাইনের কাজ করবে। এমআরটির আরামদায়ক ও নির্ভরতা যাত্রীর ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তুলবে।

কোনো উন্নয়নই এক প্রান্তিক নয়। অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। দেশে বিনিয়োগ বাড়ে। মানুষের কর্মসংস্থান হয়, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। আর তার জন্য একটি শুভ সূচনার প্রয়োজন। মেট্রোরেল হাজার হাজার কর্মঘণ্টা সাশ্রয় করবে। একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও নতুন আবাসন গড়ে উঠছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়